ঘুরে ফিরে আসে ‘মে’ দিবসের প্রহসন
ইয়াসীন পাভেল, প্রতিক্ষণ ডট কম:
প্রতিবছরের মত আবারও এসেছে মহান মে দিবস। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবীতে শ্রমিকেরা অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শেষপর্যন্ত তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক মালিক সম্পর্ক, মজুরি নির্ধারণ এবং দৈনিক সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্ণয়ে সহায়তা করেছিল। তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেনী কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে।
শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় এত ঢাকঢোল পেটানো, এত আয়োজন হলেও সত্যিকার অর্থে কতটা মুক্তি পেয়েছে বিশ্বের খেটে খাওয়া, ঘাম ঝড়ানো শ্রমিক সম্প্রদায়-এ প্রশ্ন খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীবাসীর সামনে। ১০০ বছরের বেশী সময় পেরিয়ে গেলো শ্রমিকের মুক্তির নামে আস্বাসে পেটানো ঢোল। এতে ঢোলেরই যা ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে। আজও শ্রমিক আঠারো ঘন্টা কাজ করে মরে কারখানার ধোঁয়া আর কালিতে। অল্প বয়সে রোগে ভূগে, জরাজীর্ণ হয়ে ধুকে ধুকে মরে এই শ্রমিকেরা। জোড় করে বাধ্য করা হয় কাজ করতে। বিনিময়ে কি পায় তারা? কতটুকু পেলো মর্যাদা?
বর্তমান সময়ের শ্রমিকরা হয়ত শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার পেয়েছে, পেয়েছে মে দিবসের ছুটিতে গালভরা কিছু বুলি আওড়ানোর জন্য সভা সেমিনার করার সুযোগ। কিন্তু এগুলোতে তাদের কোনই লাভ হচ্ছে না। একদিকে শ্রমিকদের অধিকার দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন করার, আন্দোলন করার, অপরদিকে মালিককে চাপে ফেলানো হচ্ছে দ্রব্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে। মালিকরা যদি শ্রমিক ইউনিয়নের চাপ, অসহোযোগ আন্দোলন, লক-আউট ইত্যাদির কারণে তাদের দাবি দাওয়া মেনেও নেয়, মজুরি বৃদ্ধি করে- ওদিকে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো যাতায়াত ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। বেতন বাড়লো তো সবকিছুর দাম বাড়লো। ফলে শ্রমিকের মজুরি দু’ টাকা বাড়লে ব্যয় বাড়ে দশ টাকা।
এভাবেই আবর্তিত হয় শোষণের চক্র, ঘুরে ফিরে আসে ‘মে’ দিবসের প্রহসন। সেই সাথে শ্রমিক আজও মরে কারখানায় আগুন লেগে, ভবন ধসে, কলে চাপা পড়ে। কাগজে কলমে বড় বড় সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ দেখায় ৮ ঘন্টার বেধে দেয়া কাজের সময়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজও তাদের খেটে মরতে হয় দিনে আঠারো ঘন্টা। হাড় জিরজিরে এই শ্রমিকের ঘাড়ে চেপে আছে প্রভুদের উপভোগের দায়। তারপরেও প্রভুদের আরাম আয়েশ আর বিলাসীতাকে আরো নিচ্ছিদ্র করতে ছাটাই করা হয় সাধারণ শ্রমিকদের।
তাহলে কি দিলো এই দিবস? সভ্যতার গর্ব যে অবকাঠামো, দালান কোঠা, চোখ জুড়ানো নান্দনিক স্থাপত্য, সেতু- কার শ্রম দিয়ে গড়া এই সব? যার শ্রমে গড়া সেই শ্রমিকের নাম কি খুঁজে পাওয়া যায় কোথাও? একবারও কি উচ্চারিত হয় তা? তাই বার বার মে দিবস এসে মনে করিয়ে দিয়ে যায় শ্রমিকের না পাওয়ার কথা, বঞ্চনা আর শোষণের কথা।
অন্যান্য দিবসগুলোর মত আজও কিছু ব্যক্তি বক্তব্য বিবৃতি দিবে, শোনাবে শ্রমিকদের মুক্তির সুশ্রবণীয় কাব্যিক বাণী। টকশো মাতাবে বুদ্ধিজীবির দল। প্রেসক্লাবে হবে গোলটেবিল-সেমিনার। কিন্তু শ্রমিকের মুক্তি এবং শ্রমের মর্যাদা কি সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে? শ্রমিকের রক্তে গড়া বড় বড় অট্টালিকায় বসবাসকারীরা কি আপসে তাদের ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে, অন্যায়- অন্যায্য নীতিকে বর্জন করবে? কিন্তু কবি তো বলে গেছেন,
“আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋন!”?
প্রশ্ন হলো কে এনে দিবে তাদের এই শুভদিন? যারা প্রকৃতপক্ষে মূল্যায়ন করবে তাদের- কোথায় তারা? কোন ব্যবস্থা দিবে তাদের মুক্তি,কে গাইবে শ্রমিকদের জন্য এই স্তবগান,
“হাঁতুড়ি শাবল গাইতি চালিয়ে ভাঙ্গিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাদেরই গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।”?
প্রতিক্ষণ/এডি/পাভেল